ভাই দুইটা পায়ে ধ’রি, আর মাইরেন না, ভাই আমি রোজা রাখছি

মাই’রেন না, ভাই আমি রো’জারাখছি, আর আ’মুনা ভাই। রোজার কথা শুনে থেমে গে’লো দু’জন। বাড়ি কই তোর? কলা’বাগান বস্তি’তে।তুই মসজিদ থেকা চু’রি করস? তোর কলিজা কত বড়?

পাশের লোকটা বললো ভাই থাম’লেন কেন? দেন আর কয়ডা, রোজার মাসে চু’রি কইরা বেড়ায়, সালারে লা’ত্থি দেন, তুই চু’রি করস আবার কিসের রোজা রাখস রে? মিছা’কথার জায়গা পাস না?

এই বলেই কান বরা’বর সজোরে আরেকটা থা’প্পড় বসিয়ে দিলো। ছেলেটা গা’লে হাত দিয়ে দে’য়াল ঘেসে বসে রইলো, কা’ন্না আর হই হু’ল্লো’ড়ের শব্দে ইমাম সাহেব দো’তলা থেকে নেমে এলেন, দেখলেন মসজিদের আঙি’নায় লোক জ’ড়ো হয়ে আছে। মসজিদে আজ ইফতারির ব্যাপক আয়োজন চল’ছিল। ইমাম এগিয়ে গিয়ে বললেন, কি হইছে এখানে?

– হুজুর চো’র ধরছি! ছেঁ’চড়া চো’র!

ইমাম সাহেব এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ১২-১৩ বছরের এক ছেলে দে’য়াল ঘেসে বসে আছে, ছেলে’টির পুরো গাল চো’খের পানিতে ভে’সে গেছে, গায়ের র’ঙ কা’লো হলেও আঘা’তের দা’গ গু’লো স্প’ষ্ট ফুটে উঠেছে। ইমাম সামনে আসাতে ছেলেটি আরও ভ’য় পেয়ে গেলো। এবার আর তার রেহাই নাই, হাত পা কাঁপছে।

– কি চু’রি করছে? দেখি?

পাশে লোকটি পলি’থিনের পো’টলা এগিয়ে দিয়ে দিয়ে বললো দেখেন হু’জুর, দেখেন, ইফতারের আয়োজন হচ্ছে, এই ফাঁকে শালায় পলিথিনে ভইরা লইছে। এক্কে’রে হাতে’নাতে ধরছি! হুজুর পলিথিন হাতে নিয়ে দেখলেন আধা কেজির মত জিলাপি, ৬ টা আপেল, আর কিছু খেজুর ভিতরে ছিলো।

হুজুর বললেন, তাই বইলা এভাবে গণ’পি’টুনি দিছো কেন? এইটা কেমন বিচার? বাচ্চারে কেউ এভাবে মারে নাকি?

এবার লোক জনের উত্তে’জনা একটু থেমে গেলো।

হু’জুর ছেলেটিকে জি’জ্ঞাস করেন, তর বাপ কি করে?

ছেলেটা কিছুটা সস্থি ফিরে পেলো। বললো- সাই’কেল ঠিক করতো, বাপের অসুখ তাই অহন কাম করে না। হুজুর আমারে ছাইড়া দেন। আমি আগে কুনো’দিন চুরি করি নাই।

কয়েকটা বা’সায় হাত পাই’তা একটা দা’নাও সাহায্য পাই নাই। পরে দেহি মস’জিদে খাবার। বাড়িতে নিবার জন্যে তুই’লা নিছি। ভুল হইয়া গেছে আমারে মাফ কইরা দেন।

পাশ থেকে লোক’গুলো বলছে, এগু’লা সব মি’থ্যা’কথা, ধরা খাইয়া এখন ভদ্র সাজে। হু’জুর বললেন, ইফ’তার শেষ হোক, সত্য মি’থ্যা দেখে ওর বাপের কাছে জা’নিয়ে সতর্ক করে দেয়া হবে। ছেলেটাকে কেউ পানি দেও, ও অনেক হাঁপাচ্ছে।

একজন পা’নির বোতল এগিয়ে দেয়। ছেলেটি উত্তর দেয়, আমি রোজা!

ইমাম সাহেব এবার লোক’গুলোর দিকে একটু বি’রক্ত মুখে তাকালেন। ছেলেটিকে অজু করিয়ে তার পাশে বসিয়ে ইফতার করালেন।

ইফতার আর নামাজ শেষে সেই দুই জন লোক ও ছেলেটিকে নিয়ে ইমাম সাহেব বস্তির দিকে এগু’লেন। এক চালা টিনের ঘর, বাইরে দুয়ারে ছেলেটির বাবা বসে আছে। সব কিছু শুনে বাবাটি তার ছেলের গালে থা’প্পড় মা’রার জন্যে হাত উঠায়। হু’জুর বাধা দিয়ে বলেন, যথেষ্ট মার হইছে, ওরে আর মাইরেন না।

বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে, বিশ্বাস করেন হুজুর, আমার ছেলেরে আমি এই শিক্ষা দেই নাই। বেশ কয়দিন ধইরা আমার অসুখ। কাম কাজ নাই, পোলা’পান’গো ঠিক মত খাও’ন যো’গাইতে পারি না। কিন্তু পো’লায় চু’রি করবো কুনো’দিন ভাবি নাই। ও অমন পোলা না।

এরই মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ছেলেটির বোন। মেয়েটার বয়স ছয় বছরের মতো। বোনটি তার ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, কোমল স্বরে বলে, ভাই, জি’লাপি আনো নাই? তুমি না আইজকা জিলাপি আনবা কইছো? ভাই’য়ের মুখে কোনো কথা নেই, চুপ করে দাঁ’ড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই আরেকটি চার বছ’রের ছোট্ট বোন ঘর থেকে ছুটে এসে বলে, ‘ভাই, ওরে না, ওরে না আমারে আগে দিবা, আমারে।’

এই বলেই হাতটি বাড়িয়ে দেয়, ভাইয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ভাই তুমি একলা একলাই খাইয়া আইছো? আমার জন্যে আনো নাইই? ভাইটি এবার ছোট বোনের কথা শুনে কেঁদে ফেলে।

বোন দুইটা মন খারাপ করে ঘরে ঢুকে যায়। ছোট বোনটা মায়ের কোলে উঠে কান্নাজুড়ে দেয়। মা আচলে মুখ ঢেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। বলেন, মাইয়া দুইটা কয়দিন ধইরা জিলাপি খাইতে চাইতেছে, ওগো বাপের অসুখ।

টেকা পয়সাও নাই, তাই পোলারে বাইরে পাঠাইছিলাম বাড়ি বাড়ি গিয়া কিছু সাহায্য চাইয়া আনতে। ছোট মানুষ বুঝে নাই, তাই ভুল করে ফেলছে। খাবার সামনে পাইয়া নিয়া নিছে, অরে আফনেরা মাফ কইরা দিয়েন।

এদিকে বাচ্চা মেয়েটা চোখ ভিজিয়ে মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে নালিশ করেই যাচ্ছে- মা, ভাই আইজকাও জিলাপি আনে নাই, ভাই আমাগো খালি মিছা কথা কয়! ভাইটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বোনটি খেয়াল করে ভাইয়ের শার্টের পকেট ভেজা!

– ভাই তোমার পকেটে কি? এই বলেই হাত ঢুকিয়ে দেয়, বের করে দেখে দুইটা জিলাপি! ভাই তুমি আনছো? দুই বোনের মুখে হাসি ফুটে উঠে!

ভাইয়ের মুখ এবার ভয়ে চুপসে যায়। লোকদুটির দিকে ভয়ার্ত ভাবে তাকিয়ে বলে, স্যার, এইটা আমি চুরি করি নাই। হজুরের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, বিশ্বাস করেন হজুর, এইটা আমার ভাগের জিলাপি, ইফতারির সময় আমার ভাগেরটা উঠাইয়া রাখছিলাম বোইন দুইটার জন্যে, সত্যি আমি চুরি করি নাই হজুর।

সবাই স্ত’ব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হজুর ছেলেটারে টেনে বুকে জড়িয়ে নেন। মাথাটা বুকে চেপে ধরে রেখে চোখের পানি ফেলতে থাকেন। লোক দুইজন এবার সশব্দে কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটির বাবার কাছে এগিয়ে যায়। তার হাতদুটি ধরে বলে, ভুল হয়ে গেছে আমাদের, আপনার ছেলের গায়ে হাত তুলছি আমরা, মাফ করে দিয়েন আমাদের।

লোকটি পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, এখানে যা আছে তা দিয়ে বাচ্চাদের কিছু খাওয়াবেন। তারা লজ্জায় আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না, বিদায় নেয় দ্রুত। আমরা শুধু অপরাধীকে দেখি কিন্তু অপরাধের পেছনের অংশটুকু দেখি না, দেখতে চাইও না।
.
সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
আরেফিন_শুভ
সূএঃ ইন্টারনেট